রনি ডাকুয়া,বাগেরহাট।ঘড়ির কাঁটায় তখন সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টা। মহাবিপদ সঙ্কেতের কথা শুনে আতঙ্কিত এলাকার মানুষ। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সাথে বইছে দমকা হাওয়া। সচেতন কিছু মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে শুরু করলেও বেশির ভাগ মানুষ থেকে যায় বাড়িতে। রাত ১০টায় প্রবল বাতাসের সাথে যুক্ত হয় ভারী বৃষ্টিপাত। আঘাত হানল প্রলয়ঙ্করী ‘সিডর’। নিমিষেই উড়ে গেল ঘরবাড়ি ও গাছপালা। বঙ্গোপসাগরের সব পানি যেন যমদূত হয়ে ভাসিয়ে নিলো হাজার হাজার মানুষ। মাত্র কয়েক মিনিটে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল গোটা এলাকা। যে যেভাবে পারলেন ঝাঁপিয়ে পড়লেন বাঁচার সংগ্রামে।
পরের দিন দেখা গেল চারদিকে শুধুই ধ্বংসলীলা! উদ্ধার করা হলো লাশের পর লাশ!দাফনের জায়গা নেই, রাস্তার পাশে গণকবর করে চাপা দেয়া হলো বহু হতভাগার লাশ। স্বজন আর সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেল বাগেরহাটের অনেক মানুষ।
সিডরের সেই ভয়াল ১৫ নভেম্বর আজ! ২০০৭ সালের এই দিনে ঘটে যাওয়া দুঃসহ সেই স্মৃতি আজও কাঁদায় বাগেরহাটসহ দণিাঞ্চলের উপকূলীয় জেলার স্বজনহারা মানুষদেরকে। ১৩ বছর আগের এ দিনটিতে সিডর নামক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল দেশের দক্ষিণ উপকূলবর্তী জেলাগুলোয়। লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল সমগ্র উপকূল,প্রকৃতি ও মানবতাকে। ধ্বংস্তুপে পরিণত হয়েছিল বাগেরহাটের শরণখোলা, মোড়েলগঞ্জসহ সবকয়টি উপজেলা। এ ভয়াবহ স্মৃতি আর বেদনা প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে জড়িয়ে আছে। শতাব্দীর ভয়াবহ ওই ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ। নিখোঁজ হয়েছিল আরো সহস্রাধিক। সেই সময়ে বেঁচে যাওয়াদের স্বজন হারানোর স্মৃতি এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন তারা।
সেদিন প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় জনপথগুলো মুহূর্তের মধ্যেই মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল। রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, মাঠঘাট এমনকি গাছের সাথে ঝুলেছিল শত শত মানুষের লাশ। গৃহহীন হয়ে পড়ে লাখ লাখ মানুষ।
সিডরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় বাগেরহাট, বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালী ও পিরোজপুর জেলায়। বহু মানুষ তাদের প্রিয়জনের লাশও খুঁজে পায়নি। ঘূর্ণিঝড়ের পর টানা দুই মাস পর্যন্ত স্বজন হারানোদের কান্নায় উপকূলের আকাশ-বাতাস ভারী ছিল। অতীতের সব কয়টি ঘূর্ণিঝড়ের চেয়ে ২০০৭ সালের সিডর নামের ঝড়টি ছিল বেশি হিংস্র।
বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জের আমড়বুনিয়া গ্রামের মোঃ পারভেজ তালুকদার সেই ভয়াবহ রাতের প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন। সেদিনের ভয়াল স্মৃতির বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি এখনো আঁতকে ওঠেন। বলেন, প্রতিদিনের মতো রাতের খাওয়া শেষ করে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এরপর আস্তে আস্তে শুরু হয় সিডরের তাণ্ডবলীলা। মুহূর্তের মধ্যে মোড়েলগঞ্জের আমড়বুনিয়া এলাকার সুবিশাল গাছ ভেঙে পড়া শুরু করে।পাশের এক প্রতিবেশীর গোয়ালঘর ভেঙে গরু চাপা পড়ায় উদ্ধারের জন্য প্রতাপ মিস্ত্রী নামে একজনকে সঙ্গে নিয়ে গবাদিপশু উদ্ধারের জন্য পাশের বাড়ি যান। তিনি আরও বলেন চারিদিকে তখন গাছপালা উপড়ে পড়ায় তিনি খুব ভয় পেলেও অবলাজাতিদের উদ্ধারের জন্য নিজের জীবন বাজি রেখে সেই মহৎ কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন সিডরের ভয়াবহতা এতই নির্মম হবে তা বুঝে উঠতে পারেনি উপকূলের বাসিন্দারা। সিডরের মাত্র কয়েক মাস আগে সুনামির পূর্বাভাস এবং তা আঘাত না হানায় সিডর নিয়ে আতঙ্কে ছিল না এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে।
পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার তথ্য মতে, ওই ঝড়ে উপকূলীয় এলাকাসহ প্রায় ৩০টি জেলায় প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ। নিখোঁজ হয়েছিল আরো সহস্রাধিক। সরকারি হিসাবে প্রায় ২১ লাখ ঘরবাড়ি, প্রায় ৪০ লাখ একর জমির ফসল নষ্ট হয়। মৃত্যু হয় প্রায় ৪ লাখ ৬৮ হাজার গবাদিপশুর। এর মধ্যে খুলনা বিভাগের বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরায় মারা যায় প্রায় ৭০ হাজার গবাদিপশু। বাকি গবাদিপশুর মৃত্যু হয় বরিশালের বিভিন্ন জেলায়। এ দিকে ১৫ নভেম্বর দিনটিকে স্মরণ রাখতে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় শোক পালন ও দোয়া-মাহফিলের আয়োজন করা হয়।
এখন সিডরের তাণ্ডবে পথে বসে যাওয়া মানুষ আবার বেঁচে থাকার চেষ্টায় নানা উদ্যোগ নিয়েছে। কেউ দোকান করেছে, কেউ নৌকা মেরামত করে আবার নদীতে মাছ ধরছে, কেউ বা মাছের পোনা ব্যবসায়। অনেকেরই অভিযোগ, ঘুরে দাঁড়াতে যে সহায়তা এসেছে, তা যথাযথভাবে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে পৌঁছেনি। আর সে কারণেই বহু মানুষ দেনার ভারে নুয়ে পড়েছে।
You cannot copy content of this page