রাজশাহী সিটি করপোরেশনের অধীনে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ভিত্তিতে আট থেকে ১৬ তলা উচ্চতার চারটি বহুতল ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ২০০৯ সালে, জনগণের স্বপ্ন ও নগর উন্নয়নের প্রত্যাশা নিয়ে। উদ্দেশ্য ছিল-নগরবাসীর বাণিজ্যিক ও আবাসিক চাহিদা মেটানো এবং আধুনিক নগর পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এক দশকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও কোনো ভবনের কাজই পূর্ণাঙ্গভাবে শেষ হয়নি। উল্টো এসব প্রকল্প এখন হয়ে উঠেছে অনিশ্চয়তা, হতাশা ও ভোগান্তির প্রতীক। নির্মাণাধীন ‘স্বপ্নচূড়া প্লাজা’, ‘দারুচিনি প্লাজা’, ‘বৈশাখী মার্কেট’ ও ‘সিটি সেন্টার’-এই চারটি ভবনের প্রতিটি ঘিরে রয়েছে বিনিয়োগকারী ও সাধারণ মানুষের অসহায়তার গল্প। কেউ দোকান পেতে, কেউবা ফ্ল্যাটের আশায় লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। একাধিকজন ২০১১ সালেই টাকা জমা দিয়েছেন, কিন্তু আজও তারা নিজেদের বরাদ্দ বুঝে পাননি। বিনিয়োগ আটকে থাকার কারণে অনেকেই ব্যবসা পরিচালনায় সংকটে পড়েছেন, পরিবারে নেমেছে অনিশ্চয়তার ছায়া। বেশিরভাগ ভবনের কাজ মাঝপথে থেমে আছে-কারও কারও পক্ষ থেকে জায়গা বুঝিয়ে না দেওয়ার অভিযোগ, আবার কারও বিরুদ্ধে রয়েছে আত্মগোপনের অভিযোগ। অথচ এগুলো একটি সিটি করপোরেশনের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত প্রকল্প। সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর বক্তব্যে স্বীকার করা হয়েছে, নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথ নিয়ম মেনে ভবন নির্মাণের আগেই জায়গা বরাদ্দ দিয়েছে-এটি শুধু চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন নয়, বরং নাগরিক অধিকার হরণ। দীর্ঘ সময় ধরে এসব প্রকল্প অসমাপ্ত থাকায় স্পষ্ট হয়-রাসিকের তদারকির অভাব, জবাবদিহিতার সংকট ও দায়িত্ব এড়ানোর প্রবণতা। পিপিপি প্রকল্পের মূল দর্শন ছিল-সরকারি সংস্থার সহায়তায় বেসরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে দ্রুত এবং কার্যকর উন্নয়ন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সরকারিকেই বেসরকারি অনিয়মের দায় বইতে হচ্ছে, আর ভুক্তভোগী হচ্ছে সাধারণ মানুষ। প্রয়োজন এখন এই প্রকল্পগুলো নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ নিরীক্ষা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। দায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিতে হবে এবং ব্যর্থ হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। সিটি করপোরেশনকেও নিজেদের দায় এড়িয়ে না গিয়ে জবাবদিহিমূলক কাঠামোতে প্রকল্প পরিচালনার দায়িত্ব নিতে হবে। পাশাপাশি, যেসব ব্যক্তি অর্থ জমা দিয়ে বছরের পর বছর অপেক্ষায় আছেন, তাদের ক্ষতিপূরণ বা বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগও জরুরি। রাজশাহী নগরীর উন্নয়ন দরকার, উচ্চাভিলাষী প্রকল্প দরকার-কিন্তু তার চেয়েও বেশি দরকার নির্ভরযোগ্যতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের উন্নয়ন উদ্যোগ ভবন নয়, বোঝা হয়ে না দাঁড়ায়-এটাই হোক আজকের শিক্ষা।