বাড়ছে ধর্ষণ, নির্যাতন, ও যৌন হয়রানি – বিশেষজ্ঞরা সতর্ক
বাংলাদেশে শিশু ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত পরিসংখ্যান এবং বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের অপরাধের তীব্রতা দেশটির সমাজে এক ভীতিকর সংকেত হিসাবে দেখা দিয়েছে। দেশজুড়ে শুধু মেয়েশিশুরাই নয়, ছেলেশিশুরাও এসব জঘন্য অপরাধের শিকার হচ্ছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম সাত মাসে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩০৬টি ঘটনার সংখ্যা ছুঁয়েছে। গত বছরের একই সময়ে এই সংখ্যা ছিল ১৭৫। এই পরিসংখ্যানের মাধ্যমে প্রতিভাত হচ্ছে দেশব্যাপী শিশু নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, ধর্ষণের শিকার শিশুদের মধ্যে ৪৯ জনের বয়স ০ থেকে ৬ বছরের মধ্যে, ৯৪ জনের বয়স ৭ থেকে ১২ বছর এবং ১০৩ জন কিশোরী। ৬০টি ঘটনায় ভুক্তভোগীর বয়স উল্লেখ করা হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এসব ঘটনা সমাজের কাছে এক কঠিন সতর্কবার্তা। ‘‘এই ধরনের প্রবণতা শুধু শিশুদের শারীরিক ক্ষতিই করছে না, বরং তাদের মানসিক বিকাশকেও মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে’’ বলে মন্তব্য করেন তারা। কিছু জায়গায় শিশুদের যৌন হয়রানির ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় স্কুলগুলোতে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
আইন-শৃঙ্খলার দুর্বলতা এবং সামাজিক কুসংস্কার
আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা জানিয়েছেন, শিশু নির্যাতন রোধে আইন থাকলেও, আইন প্রয়োগে দুর্বলতা, সামাজিক কুসংস্কার, পারিবারিক চাপ এবং দুর্বল তদন্ত প্রক্রিয়া অনেক ঘটনায় বিচার না হওয়ার অন্যতম কারণ।
বিশেষজ্ঞ আয়েশা আক্তার বলেছেন, ‘‘যদিও শিশু ধর্ষণ অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তবে আইনি অস্পষ্টতা এবং তদন্তের বিলম্ব মামলার নিষ্পত্তিতে বাধা সৃষ্টি করছে।’’
তাছাড়া, ‘‘ভুক্তভোগীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে আরও দৃঢ় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন’’ বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা।
বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুলে নিরাপত্তা এবং সচেতনতামূলক উদ্যোগ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্কুলে সেফটি এডুকেশন অন্তর্ভুক্ত করা এবং শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেয়ার উপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি পরিবারগুলোকেও সচেতন করা জরুরি, যাতে শিশুদের ব্যক্তিগত সীমারেখা ও নিরাপত্তা বিষয়ে তারা যথাযথ নির্দেশনা দিতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতাত্ত্বিক উপাদান
অপরাধীদের মনস্তত্ত্ব এবং সমাজে এসব অপরাধের মূল কারণগুলি গভীরভাবে বুঝে, তার ভিত্তিতে প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, রাজনৈতিক অস্থিরতা, চরমপন্থী প্রভাব এবং মানসিক বিকৃতির মধ্যে এসব অপরাধের বৃদ্ধির কারণ রয়েছে।
দ্রুত বিচারের দাবি
শাহীন আনাম, কার্যকর নজরদারি ও দ্রুত বিচার প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন, ‘‘প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ হিসেবে পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের সকল স্তরের ব্যক্তিদের শিশু সুরক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।’’
আন্তর্জাতিক উদ্বেগ
জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও বাংলাদেশে শিশু নির্যাতনের উদ্বেগজনক প্রবণতার বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বাংলাদেশ সরকারকে শিশু অধিকার রক্ষায় আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে।
উপসংহার
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশু নির্যাতন রোধে শুধু আইন প্রণয়ন যথেষ্ট নয়, দরকার এর কার্যকর প্রয়োগ, দ্রুত বিচার এবং সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধির। সঠিক আইনি প্রক্রিয়া, ভুক্তভোগী ও সাক্ষীদের নিরাপত্তা এবং শিশুদের সুরক্ষায় পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণই একমাত্র সমাধান।