• শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৩৯ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম :
কলাপাড়ায় বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতার পুজা মন্ডপ পরিদর্শন/দৈনিক ক্রাইম বাংলা।। বৈরী আবহাওয়ার মাঝেও কুয়াকাটায় পর্যটকদের বাঁধভাঙা উল্লাস/দৈনিক ক্রাইম বাংলা।। সৌদি আরবের বিখ্যাত ‘খেপসা’ খাওয়ালেন বিএনপির নেতা ইন্জিনিয়ার ফারুক/দৈনিক ক্রাইম বাংলা।। বাউফলে সেই আলোচিত হত্যা মামলার পলাতক আসামি গোবিন্দ ঘরামি গ্রেফতার/দৈনিক ক্রাইম বাংলা।। সক্রিয় হয়ে উঠেছে জাল নোট চক্রের সদস্যরা, মিলছে না প্রতিকার/দৈনিক ক্রাইম বাংলা।। বোরহান উদ্দিন পৌর ছাত্রদলের উদ্যোগে আলহাজ্ব হাফিজ ইব্রাহিমের নির্দেশে উপহার বিতরণ/দৈনিক ক্রাইম বাংলা।। নারীদের অংশগ্রহণ ছাড়া রাষ্ট্র কখনোই এগুতে পারবেনা …. তানিয়া রব/দৈনিক ক্রাইম বাংলা।। দাউদকান্দিতে কাইয়ুম মেম্বারের বিরুদ্ধে ভাতা বাণিজ্যের অভিযোগ,,,,দৈনিক ক্রাইম বাংলা জয় দিয়ে আফগানিস্তান সিরিজ শুরু করতে চায় টাইগাররা,,,,দৈনিক ক্রাইম বাংলা নতুন সিরিজে নিয়ে আসছেন টিম রবিনসন,,,,দৈনিক ক্রাইম বাংলা

জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান: এক মর্মম্পর্শী গাথা শহিদ অন্তরের মায়ের,,,,দৈনিক ক্রাইম বাংলা

রিপোর্টার: / ১১৫ পঠিত
আপডেট: শনিবার, ৯ নভেম্বর, ২০২৪

ঢাকা, ৮ নভেম্বর, ২০২৪ : নয় মাসের শিশু পুত্রসহ হামিদা বানুকে ছেড়ে স্বামী যখন চলে যায়, তখন তাঁর জীবনে নেমে এসেছিলো গভীর ঘন অন্ধকার। জীবনের ঘূর্ণিতে তিনি এতোটাই এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলেন যে কিছু সময়ের জন্য পৃথিবীতে বেঁচে থাকার ইচ্ছেই হারিয়ে ফেলেছিলেন।

শেষ পর্যন্ত এই শিশু সন্তান অন্তরই তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হয়ে ওঠে। তিনি নিজের জীবনের সকল আশা ও আকাঙ্খাকে সরিয়ে দিয়ে একমাত্র সন্তান আশরাফুল ইসলাম অন্তরকেই আঁকড়ে ধরেন। বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে অন্তর। তাই সন্তানকে একজন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলাই হামিদা বানুর একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।

অন্তরও মায়ের কষ্ট বুঝতে শেখে। মাকে ভালোবেসে, মায়ের সব ত্যাগ ও কষ্টের বিনিময়ে সে একজন কুরআন-এ-হাফিজ হয়। মায়ের আনন্দের সীমা থাকে না। কিন্তু এ আনন্দ বেশি দিন স্থায়ী হলো না। ঘাতকের বুলেটে সব শেষ হয়ে গেলো। হামিদা বানুর জীবনে আরো একবার নেমে এলো ঘোর অন্ধকার।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের  চুড়ান্ত বিজয়ের দিনে অর্থাৎ ৫ আগস্ট পুলিশের গুলিতে চিরতরে নিভে যায় আশরাফুল ইসলাম অন্তরের (১৫) জীবন প্রদীপ। হামিদা বানুর সকল আশা ও স্বপ্ন চিরতরে ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়।

গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনার পতনের পর বিজয় উদযাপনের সময় উচ্ছ্বসিত জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় পুলিশ। সেই গুলিতেই শহিদ হন অন্তর।

অন্তরের শোকাহত মা হামিদা বলেন, ‘আমার স্বামী শিশু সন্তানসহ আমাকে ফেলে চলে যায়। তারপর থেকেই ছেলেকে যোগ্য করে তোলার জন্য আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করেছি। আমার ছেলের পড়ালেখার খরচ ঠিকভাবে চালানোর জন্য টাকা বাঁচাতে আমি সবসময় কামরাঙ্গীরচর থেকে পায়ে হেঁটে নিউমার্কেটে আমার কর্মস্থলে আসা-যাওয়া করতাম।’

সম্প্রতি রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার ডেমরা থানাধীন দোগাইর এলাকায় বাসসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে একমাত্র সন্তানকে নিয়ে তার জীবন সংগ্রামের কথা স্মরণ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন হামিদা।

তিনি জানান, চাকরির পাশাপাশি সন্তান লালনপালন করা সম্ভব ছিলো না বলে, অন্তরকে তার নানুর বাসায় রেখে বড় করেছি। ডোগাইর এলাকায় নানুর বাসায় তার খালারা তাকে লালন পালন করেন।

অন্তরের খালা খুকু মনি অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে বাসসকে বলেন, ‘আমার বোন অন্তরের জন্য তার প্রায় সারা জীবনের সুখ বিসর্জন দিয়েছে। তার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর শিশু অন্তরের ভবিষ্যতের কথা ভেবে নয় বছর ধরে সে বিয়ে করেনি। পরবর্তিতে অন্তর একটু বড় হলে ছয় বছর আগে আমরা তাকে বিয়ে করতে বাধ্য করি।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা অন্তরকে লালন-পালন করেছি, কিন্তু তার মা বাইরে কাজ করে অন্তরের সমস্ত খরচ বহন করেছেন।’

অন্তরের মা হামিদা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমি আমার ছেলেকে বড় করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছি। আমার ছেলেকে কুরআন-এ-হাফিজ পড়ানোর জন্য যে মাদ্রাসায় ভর্তি করেছিলাম সে মাদ্রাসায় ধনী পরিবারের ছেলেমেয়েরাই সাধারণত পড়াশোনা করে।’

অন্তরের পড়ালেখার ব্যাপারে তার বর্তমান স্বামী মালয়েশিয়া প্রবাসী ফেরদৌস খান সহযোগিতা করেছেন বলেও হামিদা জানান।

তিনি আরো জানান, বাংলাদেশ পুলিশে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন ছিল অন্তরের। এ লক্ষ্যে চলতি বছরের জানুয়ারিতে দোগাইর এলাকার সিদ্দিক-ই-আকবর (রা.) ইনস্টিটিউটে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয় অন্তরকে।

হামিদা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার স্বপ্ন ছিলো, আমার ছেলেই আমার নামাজে জানাজা পড়াবে। সে লক্ষ্যেই আমি আমার ছেলেকে কুরআন-এ-হাফিজ বানিয়েছিলাম। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেলো। আমার সব শেষ হয়ে গেছে। পুলিশের গুলি আমার ছেলের জীবন কেড়ে নিয়েছে। এখন কে আমার লাশ কবরে নিয়ে যাবে, নামাজে জানাজা পড়াবে? কেই বা আমার জন্য দোয়া করবে?’

তিনি আরো বলেন, ‘আমি কখনই ভাবিনি আমার ছেলে এত কম বয়সে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। আমার ছেলে দেশের একজন যোগ্য নাগরিক হতে পারত। কিন্তু নৃশংস এ হত্যাকাণ্ড আমার সব স্বপ্ন ও আশা ধুলিস্যাৎ করে দিয়েছে।’

অন্তরের খালা খুকুমনি জানান, অন্তরের রাজপথের আন্দোলনে যোগ দেয়ার ব্যাপারে তাদের পরিবার কিছুই জানতো না। প্রতিবেশীদের কাছে এ ব্যাপারে জানতে পেরে অন্তরকে জিজ্ঞাসা করা হলে সে তা অস্বীকার করে। পরে অন্তরের আন্দোলনে যোগ দেওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হলে অন্তরের মা তাকে মারধোর করতে যান। কিন্তু তখন আমি তাকে বাধা দেই।
কাঁদতে কাঁদতে খুকুু মনি বলেন, ‘আজ আমার মনে হচ্ছে তার মাকে মারতে বাধা দিয়ে আমি ভুল করেছি। আমি যদি তার মাকে মারতে দিতাম তাহলে হয়তো অন্তর আমাদের মাঝেই থেকে যেত। এই অল্প বয়সে আমাদের ছেড়ে যেতো না।’

তিনি বলেন, ৪ আগস্ট অন্তর আবার বিক্ষোভে যায় এবং তার বন্ধুদের বলে, ‘আমি জানি না আমি ফিরব কি না।’

খুকু মনি বলেন, সেদিন, অন্তর বাড়িতে এলে, আমি তাকে বকাবকি করেছিলাম এবং অনেক লোককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে বলে তাকে বাইরে যেতে নিষেধ করেছিলাম। তিনি বলেন, ৫ আগস্ট দুপুর ১২ টা থেকে সাড়ে ১২ টার মধ্যে দুপুরের খাবার খেয়ে অন্তুর কাউকে কিছু না বলে বাড়ির বাইরে চলে যায়। এরপর থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত অন্তর নিখোঁজ ছিলো। এসময় যাত্রাবাড়ী এলাকায় এলোমেলোভাবে অন্তরকে খোঁজাখুঁজি করেও কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।’

তিনি বলেন, ‘অন্তর গুলিতে প্রাণ হারাবে, তাকে হত্যা করা হবে, এটা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। তাই ৭ আগস্ট পর্যন্ত, আমরা তাকে হাসপাতালে খুঁজিনি। কিন্তু এরপর আমার মা এবং আমি তাকে সব হাসপাতালে খুঁজতে শুরু করি। কিন্তু খুঁজে পাওয়া যায়নি। তখন আমরা আরো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি।’

একপর্যায়ে শনির আখড়ায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণরত এক শিক্ষার্থী অন্তরের স্কুল আইডি কার্ডের ফটোকপি ও ছবি দেখে খুকুুমনিকে দনিয়া কলেজে নিয়ে যায়। পরে ওই শিক্ষার্থী খুকুমনিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল ও মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, শনির আখড়া এলাকায় যাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে তাদের লাশ সেখানে পাঠানো হয়েছে। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অন্তরকে না পাওয়ায় তারা বাড়ি ফিরে আসেন।

খুকুুমনি বলেন, আমার বড় বোনের ছেলে হৃদয় তার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিল যে অন্তর ৫ আগস্ট থেকে নিখোঁজ রয়েছে। এই স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে আমরা জানতে পারি অন্তর আর নেই। তার মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রয়েছে।

ভারাক্রান্ত কন্ঠে তিনি বলেন, তার মৃত্যুর স্থান সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। আমরা যখন লাশটি পাই তখন আমরা দুটি গুলির চিহ্ন দেখতে পাই। একটি তার বুকের মাঝখানে এবং আরেকটি তার পায়ে। পরে একটি ভিডিওর মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত হয়েছি, অন্তর পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে।

ভিডিওটিতে দেখা যায়, যাত্রাবাড়ী থানা থেকে পুলিশ গুলি করতে করতে বেরিয়ে আসছে এবং রাস্তায় বিক্ষোভকারীদের ওপর বৃষ্টির মতো গুলি করছে। এ সময় অন্তর গুলি থেকে বাঁচতে থানার বিপরীত দিকে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের একটি পিলারের নিচে লুকানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এসময় অন্তরের একটি হাস্যোজ্জ্বল ছবি দেখাতে দেখাতে কান্নায় ভেঙে পড়েন খুকু মনি।

লাশ পেতে দুর্ভোগের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ঢামেক কর্তৃপক্ষ অন্তরের নামে মৃত্যু সনদ না দিয়ে অজ্ঞাত মৃত্যু সনদ দিয়েছে। অজ্ঞাত মৃত্যু সনদ দিয়েই অন্তরকে দোগাইর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।

অন্তরের শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যরা অন্তরসহ সকল শহিদের কবর স্থায়ীভাবে সংরক্ষণে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
তারা ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের সময় অন্তরসহ সকল হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ