
বড় ক্রেতাদের অর্ডার সরে যাচ্ছে, অনিশ্চয়তায় দেশের তৈরি পোশাক খাত
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত থেকে বড় আন্তর্জাতিক ক্রেতারা কার্যাদেশ (অর্ডার) সরিয়ে নিচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, ক্রেতাদের আস্থাহীনতা এবং সরকারি পর্যায়ের বিভ্রান্তিকর বার্তায় দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাতটি এখন গভীর অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। ফলে পোশাক ও বস্ত্র রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ক্রমেই নিম্নগামী হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক ক্রেতারা সরবরাহ স্থিতিশীলতা ও আস্থাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন। বর্তমানে দেশে ধারাবাহিকভাবে একের পর এক পোশাক কারখানা বন্ধ হচ্ছে। এতে অনেক বড় ব্র্যান্ড তাদের অর্ডার বিকল্প উৎপাদনকারী দেশ—ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার দিকে সরিয়ে নিচ্ছে।
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও বিভ্রান্তিকর বার্তার প্রভাব
সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব নন-কমপ্লায়েন্স কারখানা বন্ধ হওয়াকে শিল্পের “সুষ্ঠু ও টেকসই উন্নয়নের অংশ” বলে মন্তব্য করেন। তবে খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, এ ধরনের মন্তব্য ও সিদ্ধান্ত বড় ক্রেতাদের মধ্যে নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছে। তারা মনে করেন, হঠাৎ করে কারখানা বন্ধ করে দেয়া কোনো সমাধান নয়; বরং কারখানাগুলোর পরিবেশ, নিরাপত্তা ও শ্রমিক সুরক্ষা উন্নয়নের দিকেই জোর দেয়া উচিত।
রপ্তানিতে পতনের ধারা
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)-এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই রপ্তানিতে পতন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শুধু অক্টোবর মাসেই রপ্তানি আয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭ শতাংশের বেশি কমেছে। মাসটিতে প্রায় ৫১ কোটি ডলার বা ৬ হাজার ১২০ কোটি টাকার রপ্তানি ঘাটতি দেখা গেছে।
২০২৪ সালের অক্টোবরে যেখানে ৪১৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল, সেখানে ২০২৫ সালের অক্টোবরে তা নেমে এসেছে ৩৬২ কোটি ডলারে। এ নিয়ে টানা তিন মাস ধরে রপ্তানি কমছে।
শতাধিক কারখানা বন্ধ, লাখ শ্রমিক বেকার
বিজিএমইএ সূত্রে জানা যায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে গত এক বছরে ২৫৮টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে এক লাখের বেশি শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। একই সময়ে নতুন ১৬৬টি কারখানা চালু হলেও, সামগ্রিক কর্মসংস্থান ও উৎপাদন সক্ষমতায় ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে।
কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কেবল উৎপাদনই নয়, শ্রমিকদের জীবনযাত্রা, পরিবারের আয় ও শিশুদের শিক্ষাজীবনও বিপর্যস্ত হচ্ছে। অনেক শ্রমিক পরিবার বাসা ভাড়া দিতে পারছে না, কেউ কেউ শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
“কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা, বন্ধ নয়” — বিশেষজ্ঞদের মত
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)-এর নির্বাহী পরিচালক ও শ্রম সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন,
> “কমপ্লায়েন্স বা নন-কমপ্লায়েন্স কারখানা হঠাৎ করে বন্ধ করে দেয়া কোনো সমাধান নয়। বরং এই কারখানাগুলোকে পরিপালনযোগ্য ও উপযুক্ত পরিবেশে নিয়ে আসতে হবে। কারণ ছোট-বড় সব কারখানাই বৃহৎ সরবরাহব্যবস্থার অংশ। হঠাৎ বন্ধ হলে পুরো সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়ে এবং আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে নেতিবাচক বার্তা যায়।”
তিনি আরও বলেন, দেশের শিল্পখাতের বড় অংশ এখনো পূর্ণ কমপ্লায়েন্সের আওতায় আসেনি। তাই সরকার, মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়িয়ে কারখানাগুলোর অবকাঠামো ও কর্মপরিবেশ উন্নয়ন করাই এখন জরুরি।
খাতের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ
রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা হ্রাস—এসব একসাথে তৈরি পোশাক খাতকে চাপে ফেলছে। এতে শুধু শিল্প মালিকরাই নয়, পুরো দেশের রপ্তানি আয়ের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
শিল্প সংশ্লিষ্টদের মতে, এখনই যদি সরকারের পক্ষ থেকে শিল্পে আস্থা ফিরিয়ে আনতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া না হয়, তবে বড় ক্রেতারা দীর্ঘমেয়াদে অন্য দেশে অর্ডার সরিয়ে নেবে—যা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাতের জন্য বড় বিপদ ডেকে আনবে।
—