দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ কাঠামোতে এক ধাপ এগিয়ে গেল বাংলাদেশ। জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনের বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনার পর জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জানিয়েছে, এই কক্ষ হবে ১০০ আসনের এবং সদস্যরা মনোনীত হবেন পিআর (Proportional Representation) বা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে। অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো যে পরিমাণ ভোট পাবে, তার ভিত্তিতেই তাদের মধ্যে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন করা হবে।
বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের ২৩তম দিনের আলোচনা। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামি, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), গণসংহতি আন্দোলনসহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি।
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, সংলাপের মাধ্যমে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে এবং যেসব ক্ষেত্রে ভিন্নমত রয়ে গেছে—তার একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা শিগগিরই দলগুলোর কাছে পাঠানো হবে। তিনি বলেন, ‘‘আমরা চূড়ান্ত সনদ তৈরির কাজ দ্রুত শেষ করতে চাই, যাতে স্বাক্ষরের আয়োজন করা যায়।’’
কমিশনের এই প্রস্তাবে সমর্থন জানিয়েছে এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামি। তাদের মতে, ভোটের ভিত্তিতে আসন বণ্টনের এই পদ্ধতি সংসদে বহুদলীয় প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করবে এবং জাতীয় রাজনীতিকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করবে।
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, “এক শতাংশ ভোট পেলেও যেন কোনো দল উচ্চকক্ষে একজন প্রতিনিধি মনোনীত করতে পারে, সেটি নিশ্চিত হলে বহুদলীয় গণতন্ত্র আরও গভীর হবে। একটি দল বা জোট নয়, বিভিন্ন দল মিলে রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশ নেবে, যা গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত জরুরি।”
তিনি আরও বলেন, “আইন পাসের আগে উচ্চকক্ষে বিস্তারিত আলোচনা হলে, তা শুধু আইন প্রণয়নে নয়, বরং জনপরিসরে গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কের ক্ষেত্রও তৈরি করবে।”
অন্যদিকে বিএনপি, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২ দলীয় জোট, এনডিএম ও এলডিপি এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে। তাদের দাবি, দলগুলো যে পরিমাণ আসন পাবে, সেই অনুপাতে উচ্চকক্ষে প্রতিনিধিত্ব দিতে হবে। অর্থাৎ ‘ভোট নয়, আসনের ভিত্তিতে’ মনোনয়ন চাইছে এই জোট।
তাদের যুক্তি, ভোটের অনুপাতে আসন দিলে এমন অনেক দল উচ্চকক্ষে প্রবেশ করবে, যারা মাঠে আসন পায়নি—ফলে জনসমর্থনের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটবে না।
কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, উচ্চকক্ষের নিজস্ব কোনো আইন প্রণয়নের ক্ষমতা থাকবে না। তবে অর্থবিল ছাড়া অন্য সব প্রস্তাবিত আইনপত্র উভয় কক্ষে উত্থাপিত হবে। উচ্চকক্ষ কোনো বিল স্থায়ীভাবে আটকে রাখতে পারবে না। সর্বোচ্চ এক মাস বিল আটকে রাখার সুযোগ থাকবে। এরপর সেটিকে অনুমোদিত বলেই গণ্য করা হবে।
এছাড়া, কোনো বিল প্রত্যাখ্যান করলে তা সংশোধনের প্রস্তাবসহ পুনরায় নিম্নকক্ষে পাঠাতে হবে। নিম্নকক্ষ সেই সুপারিশ মানতে কিংবা বাতিল করতে পারবে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম সরাসরি উচ্চকক্ষ গঠনের বিরোধিতা করেছে। তাদের ভাষ্য, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক বাস্তবতায় দ্বিতীয় একটি কক্ষ সৃষ্টি করা অহেতুক ব্যয়বহুল এবং অপ্রয়োজনীয়।
এদিনের বৈঠকে সরকারি কর্ম কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং মহাহিসাব নিরীক্ষক নিয়েও আলোচনা হয়। কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এখন পর্যন্ত গৃহীত ১৬৬টি সংস্কার সুপারিশের মধ্যে অনেক বিষয়ে ইতোমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী সংসদের নিম্নকক্ষে ৪০০টি আসন রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে, যার মধ্যে ১০০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে এবং এসব সদস্য সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। উচ্চকক্ষে থাকবে ১০৫টি আসন, নির্বাচন হবে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে।
আলোচনায় এনসিপির আখতার হোসেন বলেন, ‘‘কমিশনের প্রস্তাব বাস্তবায়নের পদ্ধতি এখনো পরিষ্কার নয়। আমরা চাই, বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে খোলামেলা ও কার্যকর আলোচনা হোক। তৎক্ষণাৎ বাস্তবায়ন শুরু হোক, দেরি না করে।’’
আখতার হোসেন বলেন, “আমরা চাই না, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কোনো দল যেন সংবিধান সংশোধন করতে পারে। উচ্চকক্ষে যদি পিআর পদ্ধতিতে বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়, তবে সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রেও সঠিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে।”
তিনি যোগ করেন, “বাংলাদেশের রাজনীতিকে সংঘাত ও হানাহানির পথ থেকে সরিয়ে নীতিনির্ভর ও সংলাপনির্ভর সংস্কৃতির দিকে নিয়ে যেতে হলে এমন উচ্চকক্ষ অপরিহার্য