বরগুনা প্রতিনিধি/আলিম পাস করে বরগুনা আলীয়া মাদ্রাসায় পিয়ন হিসেবে চাকুরী, অত:পর পরীক্ষার অতিরিক্ত (লুচ) পেপার জালিয়াতির অভিযোগে কারাভোগ করে বরখাস্ত। এরপর ডিগ্রী পাসের ভূয়া সনদ দেখিয়ে কলেজের অধ্যক্ষের পদ ভাগিয়ে নিলেও পরবর্তীতে সনদ জালিয়াতির কারনে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। বর্তমানে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে অবৈধভাবে পুন:রায় একই কলেজের অধ্যক্ষের পদ দখলের চেষ্টা। আর এসব অভিযোগ বরগুনার আমতলী উপজেলার বকুলনেছা মহিলা ডিগ্রী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মোঃ ফোরকান মিয়ার বিরুদ্ধে। তার এসব অপকর্মের অভিযোগ করেছেন ওই কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোঃ মজিবুর রহমান।
জানা গেছে, আমতলী উপজেলার প্রাণ কেন্দ্রে অবস্থিত বকুলনেছা মহিলা ডিগ্রী কলেজে ১৯৯৯ সালে মোঃ ফোরকান মিয়া বিএ (পাস) জাল সার্টিফিকেট গোপন রেখে ইসলামী শিক্ষা বিষয়ের প্রভাষক পদে চাকুরী নেন। ২০১০ সালে তিনি জাল জালিয়াতির মাধ্যমে ওই কলেজের অধ্যক্ষ পদে আসীন হন। অধ্যক্ষ হয়েই নিয়োগ, জাল সার্টিফিকেট বানিজ্য ও অর্থ আত্মসাৎসহ নানাবিধ অপকর্মে জড়িয়ে পরেন। অধ্যক্ষ পদে আসীন হওয়ার তিন বছরের মাথায় ২০১৩ সালে দুণর্ীতি, অর্থ আত্মসাৎ ও সার্টিফিকেট জালিয়াতির অভিযোগে কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটি তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে সহকারী অধ্যাপক প্রনব কুমার সরকারকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেন। সাময়িক বরখাস্তের পরেই এক এক করে বেড়িয়ে আসে তার অপরাধ চিত্র। ব্যবস্থাপনা কমিটি তদন্ত কমিটি খুজে পান তার অর্থ আত্মসাৎ, নিয়োগ ও জাল সার্টিফিকেটের বানিজ্য।
মোঃ ফোরকান মিয়া আমতলী সরকারী কলেজে ১৯৯০-৯১ শিক্ষা বর্ষে বিএ শ্রেনীতে ভর্তি হন। ১৯৯২ সালের ডিগ্রী পাস (অনুষ্ঠিত ১৯৯৩ সালে) নিয়মিত ছাত্র হিসেবে পরীক্ষায় অংশ গ্রহন করেন। তার রেজিষ্ট্রশন নম্বর- ৫৩৭৫০ ও রোল নং- ৬৫৮। তিনি ওই বছর পরীক্ষায় অংশগ্রহন করলেও তার ফলাফল স্থগিত থাকে। কিন্তু তিনি জালিয়াতি করে ওই বছরই বিএ পাস সার্টিফিকেট সংগ্রহ করেন এবং ওই সার্টিফিকেট দিয়েই বকুলনেছা মহিলা কলেজে চাকুরী নেন। কিন্তু আমতলী সরকারী কলেজ থেকে তিনি বিএ পাস পরীক্ষায় অংশগ্রহন করে উত্তীর্ণ হয়নি মর্মে ওই কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ মজিবুর রহমান প্রত্যয়ন পত্র দেন। এ ঘটনার পর তিনি স্বেচ্ছায় বকুলনেছা মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
এরপরও তার সার্টিফিকেটের অধিকতর সত্যতা যাচাই বাছাইয়ের জন্য তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ প্রনব কুমার সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের বরাবরে আবেদন করেন। উক্ত আবেদনের প্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. হিমাদ্রী শেখর চক্রবতী মো: ফোরকান মিয়ার ডিগ্রী (পাস) ১৯৯২ সনদ জাল মর্মে প্রত্যয়ন দেন।
পরবর্তীতে ফোরকান মিয়া আদালতে তার আমতলী কলেজের ডিগ্রী পাসের সনদ অস্বীকার করে প্রিমিয়াম ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি নামক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ডিগ্রী পাসের সনদ দাখিল করেন। কিন্তু বিশ্ব বিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনে উক্ত সনদপত্রের সত্যতা যাচাই করতে গেলে, বিশ্ব বিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের উপ-পরিচালক জেসমিন পারভীন স্বাক্ষরিত একটি পত্রের মাধ্যমে জানান, প্রিমিয়াম ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি নামক তথাকথিত প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ বিশ্ব বিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত নয় এবং অননুমোদিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ডিগ্রী গ্রহণযোগ্য নয়।
এরপর কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিয়োগের জন্য সর্বশেষ ২০১৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর বিজ্ঞপ্তি দেন ব্যবস্থাপনা কমিটি। কিন্তু মো: ফোরকান মিয়া ওই সময় মহামান্য হাইকোর্টে পদ, বেতন ভাতা ফিরে পাওয়া ও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বন্ধে হাইকোর্টে রীট পিটিশন দাখিল করেন। মহামান্য হাইকোর্টের বিচারক অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন। তবে তার অধ্যক্ষ পদ পুনর্বহাল এবং বেতন ভাতার বিষয়ে কোন আদেশ দেয়নি।
এরপরেও ফোরকান মিয়া ২০২০ সালের ২৩ জুলাই বরগুনা জেলা প্রশাসক বরাবরে বেতন ভাতা চেয়ে মানবিক আবেদন করেন। কিন্তু জেলা প্রশাসনের সহকারি কমিশনার (শিক্ষা ও কল্যাণ শাখা) নাজমুন লায়েল গত ৩০ জুন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে জানান, মো: ফোরকান মিয়ার বেতন ভাতার সরকারি অংশ দেওয়া না দেওয়ার বিষয়টি মহামান্য হাইকোর্টে বিচারাধীন অবস্থায় আছে। অতএব এ বিষয়ে কোন মতামত দেওয়ার এখতিয়ার নাই।
কিন্তু মহামান্য হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করে গত ১৯ জুলাই কলেজ বন্ধ থাকাকালিন সময়ে সাবেক অধ্যক্ষ মোঃ ফোরকান মিয়া রাজনৈতিক প্রভাবে অধ্যক্ষের চেয়ার দখল করে বেআইনী ভাবে কার্যক্রম চালানোর চেষ্টা করছেন। এছাড়াও মো: ফোরকান মিয়া ১৯৯০ সালে বরগুনা আলীয়া মাদ্রাসায় পিয়ন হিসেবে চাকুরী করাকালীন পরীক্ষার অতিরিক্ত (লুচ) পেপার চুরির দায়ে মামলায় আসামী হয়ে কারাভোগ করেন। পরবর্তীতে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ তাকে চাকুরী থেকে অব্যাহতি দেন।
এদিকে ফোরকান মিয়ার এসব কর্মকান্ডের কারনে কলেজের শিক্ষক-কর্মচারী, শিক্ষাথর্ী ও অভিভাবকদের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে। তাদের দাবি জাল সার্টিফিকেটধারী ফোরকান মিয়া পুন:রায় যেন কোন ভাবেই অধ্যক্ষের পদে আসীন হতে না পারেন।
কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো: মজিবুর রহমান বলেন, মহামান্য হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করে বর্তমান এডহক কমিটি জাল সার্টিফিকেটধারী মো: ফোরকান মিয়াকে অধ্যক্ষের দায়িত্ব দিয়েছেন। যা হাইকোর্টের আদেশ অবমাননার শামিল। তিনি আরো বলেন, ফোরকান আমার স্বাক্ষর জাল করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এডহক কমিটি পরিবর্তনের আবেদন দিয়েছেন। দ্রুত জাল সার্টিফিকেটধারী ফোরকানকে কলেজ থেকে অব্যহতি দেয়ার দাবী জানাই।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত সাবেক অধ্যক্ষ মো: ফোরকান মিয়া বলেন, ২০১৩ সালে তৎকালীন ব্যবস্থাপনা কমিটি জোরপূর্বক আমার কাছ থেকে পদত্যাগপত্র নিয়েছেন। আমি তখন স্বেচ্ছায় দেইনি। জাল সার্টিফিকেটের বিষয়ে ফোরকান মিয়া বলেন, আমতলী কলেজের ডিগ্রী পাসের সার্টিফিকেট আমার না, ওটা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আমার নামে বানিয়েছে। কিন্তু প্রিমিয়াম ইউনিভার্সিটি এন্ড টেকনোলজি কর্তৃক দেয়া ডিগ্রীর সনদপত্র বৈধ বলে তিনি দাবি করেন। অন্যদিকে বরগুনা আলীয়া মাদ্রাসা থেকে চাকুরী যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করলেও কারন বলতে চাননি।
এ ব্যাপারে কলেজের বর্তমান এডহক কমিটির সভাপতি মোসাঃ মাকসুদা আক্তার জোসনা বলেন, ফোরকান মিয়া আইনগত ভাবে অধ্যক্ষ হিসেবে থাকতে পারলে আমাদের কমিটি তাকে গ্রহণ করবে। অন্যথায় আইনগত ভাবে যা হবার তাই হবে।
বরগুনা জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, নতুন এডহক কমিটি গঠন এবং সাবেক অধ্যক্ষকে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টি ওই কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আমাকে জানিয়েছেন। তবে নতুন কমিটির কেউ জানাননি। তিনি আরও বলেন, আমি এ বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (শিক্ষা) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এখানে কোন ধরনের আইনের লঙ্ঘন হলে জাতীয় বিশ্ব বিদ্যালয়ে জানানো হবে।