লালমোহনে বিভিন্ন গ্রাম, বিল ও জনপদের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ছোট বড় অনেক খাল। এগুলো যেন এপাড়া-ওপাড়ার মধ্যে নিবিড় সেতু বন্ধন। এসমস্ত খাল মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর কাছে গোপন অভিসারে লালমোহনের ভূখণ্ডের খবরাখবর আদান-প্রদান করে। বড় বড় খালগুলো স্থানিক বিভিন্ন নামে পরিচিত আর ছোট ছোট খালগুলোকে চরা খাল বা ঝোরা খাল বলা হয়। অধিকাংশ খাল হারিয়ে যাওয়া বেতুয়া নদীর স্মৃতি বহন করে। এসব খালে মাছ ধরে অনেকে জীবিকা নির্বাহ করেন। এখানে প্রকৃতি আর মানুষের মাঝে যেন গভীর মিতালী রয়েছে। ব্যাঙের ডাক শুনলেই মানুষ বুঝে বর্ষণের আর দেরি নেই। ডাহুকের ডাক, হুতুমপেঁচার চোখ, শিয়ালের হাঁক, কাকের কা কা, ভোমরের গুঞ্জন, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, বনের বুকে সন্ধ্যার আঁধার ভেদ করে জ্বলে উঠা থোকা থোকা জোনাকির আলো, সোনালী চিল, মাছরাঙার মাছধরা এসব কতই না বৈচিত্র্যময়! তাছাড়া এখানে গাছে গাছে এবং মাঠে-প্রন্তরে ঘুঘু, ময়না, টিয়া, দোয়েল, চড়ুই, শ্যামা, হোট্রিটি, কোয়েল, কোরা, পাতিহাঁস, শালিকসহ আরও কত রং-বেরঙের বিচিত্র পাখির উড়াউড়ি চোখে পড়ে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতই এখানে ঋতু বৈচিত্র্যের খেলা চলে এবং মাটি যেন এখানে শীতল পাটি। এখানে কাদাজলে যেন মিশে থাকে মানুষের প্রাণ। প্রাচীন জীবন থেকে আমাদের মনের উপর লেগে আছে শ্যামল মাটির গন্ধ, সবুজের ছাপ। এখানে চাঁদের আলো, তারার হাসি, পাকা ধানের খিসখিস শব্দ, পাল তোলা নাও, চকচকে সাদা বক, রূপালী ইলিশ, গাছের ছায়া মন কেড়ে নেয়। চারদিকে সবুজ গাছ পালা, মাঝে মাঝে পশুপাখির ডাক আর শীতল বাতাস প্রাণে সজীবতা আনে। এখানে গভীর মায়া জড়ানো, স্বপ্নমাখা প্রকৃতি হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
ছোট ছোট ডিঙি নাও, মাছ ধরার দৃশ্য, জলাশয়ে শাপলার হাসি, কলসি কাঁখে গাঁয়ের বধূ, পথে পথে ছেলেমেয়েদের বিচরণ, ঘুরি ওড়ানো, গাছে ঝুলে রসের হাঁড়ি, তাল পাতার পাখা, তালের পিঠা, কচি ডাব, বিভিন্ন উৎসবের আমেজ, মাঠে মাঠে চিরল পাতার হাসি, পথে-প্রান্তরে ফেরিওয়ালার ঘুরে বেড়ানো, গাছের ছায়ায় ক্লান্ত পথিকের বিশ্রাম, দুরন্ত ষাঁড়ের লড়াই গ্রামবাংলার এসব চিত্র লালমোহনে অহরহ দেখা যায়।
ভোরের সূর্য ওঠার আগেই কৃষকেরা জমিতে কাজে নেমে পড়ে। কর্ম জীবনের ব্যস্ততা ছেড়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে তারা হারিয়ে যাচ্ছেন। চার পাশের খোলা মাঠ আর বিস্তীর্ণ সমতল ভূমি। পূর্বে মেঘনা আর পশ্চিমে তেঁতুলিয়া নদী লালমোহনের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে। নয়নাভিরাম প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্যে ভরা দ্বীপ জেলা ভোলা সদর থেকে ৪৮ কিলোমিটার দক্ষিণে লালমোহন উপজেলা। এটি অত্যন্ত সম্ভবনাময় একটি স্থান। স্থানীয়রা বলেন, দেশের অন্য সব পর্যটন এলাকা থেকে এই এলাকা কোনো অংশে কম নয়। যদি এই এলাকাটিকে পর্যটন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়, তাহলে পর্যটকদের পাশাপাশি স্থানীয়রাও বিভিন্নভাবে লাভবান হতো।
মেঘনা নদীর পাড়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যভরা দৃষ্টিনন্দন একটি এলাকায় লক্ষী বুড়ি নামক পর্যটন কেন্দ্রের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছেন ভোলা-৩ আসনের এমপি আলহাজ্ব নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন। এটি দ্রুত বাস্তবায়নের আশা করি। লালমোহনে তিনি মনোরম পরিবেশে সজীব ওয়াজেদ জয় ডিজিটাল পার্ক নির্মাণ করেছেন। প্রকৃতি প্রেমীদের মনের তৃষ্ণা মেটাতে এটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। যা লালমোহনের চিরায়ত ঐতিহ্যের স্বাক্ষর বহন করে। প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্যের মনোরম লীলাভূমি লালমোহন। প্রকৃতির এমন লাবন্যময় রূপ কার না নজর কাড়ে! লালমোহনের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রকৃতির প্রতিটি স্তর অবিরাম সুন্দরের হাতছানি দিয়েছে।