নুরুল আমিন।।
পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর ঘটনা সমাজ সংসারে সবাইকে আলোড়িত করে। আদরের সন্তান হারিয়ে মা-বাবার বুক ফাটা কান্দনে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। ভাইবোন, দাদা-দাদিও অঝোরে কান্দে। আত্মীয় স্বজন ও পাড়াপড়শিরাও চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে কীভাবে অবুঝ অবলা শিশু পানিতে পড়ে? এই মারাত্মক দুর্ঘটনার কারণগুলো খতিয়ে বের করে কীভাবে এগুলো রোধ করা যায়, এটাই এখন চিন্তার বিষয়।
পানির প্রতি শিশুদের দুর্নিবার আকর্ষণ রয়েছে। তারা পানি নিয়ে খেলতে ভালোবাসে। অনেকে বলে পানির ভেতর শিশুরা ফুল দেখে, তাই তারা পানির দিকে যায়। আসলে বিষয়টি তা নয়, এটা একটা কুসংস্কার। মূলত শিশু পানিতে পড়ে ডুবে মরার কারণ হচ্ছে সাঁতার না জানা। সাধারণত ঘরের পাশের পুকুর, খাল বা ডোবাতেই শিশুরা বেশি পড়ে। মা-বাবা, ভাইবোন ও পরিবারের লোকজন কাজে ব্যস্ত থাকে, ঠিক এই সুযোগে শিশু হাফুর দিতে দিতে পানিতে গিয়ে পড়ে। দেড় বা দুই বছর থেকে পাঁচ বছর বয়সি শিশুরাই বেশি পানিতে পড়ে। সকাল ৮টা বা ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটে। কারণ এসময় কর্মব্যস্ততা বেশি থাকে। বিকেলে অনেক মায়েরা দেখা যায় ঘরের বারান্দায় বা উঠানে বসে মাথায় ফিতা দেয় এবং উকুন বাছাবাছি করে, এই সুযোগে অবুঝ শিশু হাফুর দিয়ে খেলতে খেলতে গিয়ে পানিতে পড়ে। বর্ষাকালে এ দুর্ঘটনা বেশি ঘটে থাকে। শিশু পানিতে পড়ার জন্য মায়ের উদাসীনতা বেশি দায়ী। গ্রামাঞ্চলে পানিতে পড়ে শিশু মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটে।
পরিবারের অন্যান্যদের অচেতনতাকে বিশেষভাবে দায়ী করা হয়। বাচ্চার সঠিক তত্বাবধান না করা, পুকুর বা ডোবার চারপাশে বেড়া না দেওয়া, ঘরের দুয়ার খোলা রাখা, অপ্রাপ্ত বয়সি ছেলে বা মেয়ের কাছে শিশুকে রাখা, শিশুর প্রতি ঠিকমতো খেয়াল না রাখা এসব কারণে মূলত পানিতে পড়ে শিশু মারা যায়। আবার দেখা যায়, একটি শিশু পানিতে পড়লে তাকে তুলতে গিয়ে অন্য শিশুও ডুবে মরে। ঘরে বা বাথরুমে পানি ভর্তি বালতির ভেতর পড়েও শিশুর মৃত্যু ঘটে।
গরিব পরিবারে পানিতে পড়ে শিশু মৃত্যুর হার বেশি। তাদের অশিক্ষা, অসতর্কতা ও কর্মব্যস্ততা এরজন্য দায়ী। সমাজে বিরাজমান কিছু কুসংস্কার পানিতে পড়ে শিশু মৃত্যুর জন্য বিশেষভাবে দায়ী। এরমধ্যে রয়েছে পানিতে পড়া শিশুকে মা-বাবাকে ধরতে না দেওয়া, মাথায় তুলে নাচানাচি করে বা ঘোরানো, পেটে চাপ দিয়ে পানি বের করার চেষ্টা করা, বমি করানোর চেষ্টা করা প্রভৃতি। এছাড়া দ্রুত হাসপাতালে না নেওয়া কিংবা রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের শরণাপন্ন না হওয়া, গা গরম করার জন্য কাঁথা, কাপড়চোপড় বা তুলা দিয়ে ঢেকে রাখা প্রভৃতি কারণে পানিতে পড়া শিশু উপরে তোলার পরেও মারা যায়। সোজা কথা, পানিতে পড়া শিশুকে সুস্থ করার জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা জ্ঞান না থাকা, অনভিজ্ঞতা ও পাণ্ডিত্যের কারণে শিশু মারা যায়।
কেবল তাই নয়, হাসপাতালে অব্যবস্থাপনা, ডাক্তারের গড়িমসি, পানিতে পড়া শিশুর তাৎক্ষণিক কী ধরনের চিকিৎসা দিতে হবে এরকম প্রশিক্ষিত ডাক্তার, সমাজ কর্মী অভাবে এবং দায়সারা চিকিৎসার কারণে পানিতে পড়া শিশুর মৃত্যু ঘটে।
২০১৬ সালে সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) জরিপের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ১৪ হাজার ৪৩৮ জন ১৮ বছর বা তার চেয়ে কম বয়সি শিশু পানিতে ডুবে মারা গেছে। অন্যভাবে বলতে গেলে, দৈনিক ৪০ জন শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। কেউ কেউ ৫০ জনের কথা বলেছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১৮ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করেন এবং এক থেকে চার বছর বয়সি শিশু মৃত্যুর ঘটনার ৪৩ শতাংশই পানিতে ডোবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এক জরিপে বলা হয়েছে, প্রতি বছর ১৪ হাজারের মতো শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়।
পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর ঘটনা রোধের একমাত্র উপায় হচ্ছে– শিশুকে চোখে চোখে রাখা, সবাই সচেতন হওয়া, প্রাথমিক চিকিৎসা জ্ঞান অর্জন করা, প্রশিক্ষিত সমাজকর্মী তথা জনবল তৈরি করা, দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া, প্রত্যেক পাড়া-মহল্লায় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সতর্ক করা, কুসংস্কারে বিশ্বাস না করা, মা-কে কোনো কাজে ব্যস্ত না রাখা, ঘরের পাশে ডোবা না রাখা, বেড়া দিয়ে খাল ও পুকুর ঘিরে রাখা, ঘরের দুয়ারে অন্তত দেড় হাত উঁচু করে বেড়া দিয়ে দেওয়া প্রভৃতি। নিরাপদে বেঁচে থাকা শিশুর অধিকার। এটি রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব।
বাংলাদেশে পানিতে পড়ে শিশু মৃত্যুর হার অত্যন্ত ভয়াবহ। এটি থানায় বা সরকারের কোনো দপ্তরে নথিভুক্ত না হওয়ার কারণে সঠিক সংখ্যা জানা যাচ্ছে না। তবে ভয়াবহ এ সমস্যা জাতিসংঘের নজরে এসেছে। আমাদের জাতীয় পর্যায়ে নজরে এসেছে। জাতিসংঘ ২০২৩ সালে ২৫ জুলাইকে ‘পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এটি আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার এই দিবসটি আনুষ্ঠানিকভাবে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করে। পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু একটি জাতীয় সংকট। শুনেছি সরকার পানিতে ডুবে মৃত্যু নিবারণে বেশ কিছু পদক্ষেপ, নীতিমালা ও সুপারিশ গ্রহণ করেছে। কেন যে সেগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে তা অজানা। কবে এই অজানা রহস্য দূর হবে, আর কবে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে, তাও অজানা। অজানা রহস্য ও অনিশ্চিত গন্তব্যের কারণে পানিতে ডুবে যেন আর কোনো শিশুর মৃত্যু না হয়, এটাই আমাদের কামনা।
লেখক: কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক। লালমোহন, ভোলা।